চৌধুরী তানভীর আহমদ সিদ্দীকি: এই লেখাটির প্রতিটি বাক্য আমার একান্ত ব্যক্তিগত মতামত। কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়, কাউকে খুশী করতে বা কাউকে আঘাত করার উদ্দেশ্যে এই লেখাটি লেখা হয়নি। লেখাটি আশা করি সম্পূর্ণ পড়বেন এবং আপনার মতামত জানাবেন।
আমি একটি দৈনিক পত্রিকার ফিচার পেইজের সাব এডিটর, তাছাড়া শখের বশত লেখালেখি করি আইন, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে। আইনে মাস্টার্স কমপ্লিট করে যখন আদালতে যাওয়া শুরু করেছি, তখন থেকেই পারিবারিক আদালতে আমার যাওয়া আসা ছিল নিয়মিত। ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে জমি সংক্রান্ত মামলা আর পারিবারিক মামলাই সবচেয়ে পছন্দ। লেখালেখির বাতিকের কারণে, কোর্টে ঘটতে দেখা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে না লিখলেই যেন নয়।
পারিবারিক আদালতে যখনি ঢুকি তখন তো মনে হয় যেন, আমি আমার পাশের বাড়ির বা পাশের বিল্ডিং এর কোন পরিবারের ঝামেলা দেখতে এসেছি। কেননা, আমাদের চারপাশে যা কিছু ঘটে, তার পুরোটাই আমরা পারিবারিক আদালতে গিয়ে দেখতে পাই। আর মোকদ্দমা গুলোও প্রায়ই কমন; যৌতুক, নারী নির্যাতন, দেনমোহর। এই তিনটি বিষয় নিয়েই প্রতিটি জেলার আদালত গুলো ব্যস্ত সময় পার করছে। সন্তানের অভিভাবকত্ব, তালাক, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার এসবের মামলা খুবই কম। যৌতুক, নারী নির্যাতন, দেনমোহর মামলাতে আগ্রহ বাদিনীদের।
বাদিনী লিখলাম, কারণ এসব মামলার প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীরাই মামলা করে আর পুরুষ এবং তার পরিবারের লোকজন হয় বিবাদী। পুরুষ নির্যাতন নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে ফেসবুকে লেখালেখি ছাড়া আর কোন প্রকার সাংগঠনিক উদ্যোগ বা প্রচারণা দেখতে পাই না, কিন্তু আপনি যদি নিজ জেলার বা যেকোনো জেলার আদালতে যেখানেই যৌতুক বা নারী নির্যাতন বা দেনমোহরের মামলা চলে সেখানে গিয়ে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে সারাদিন শুধু মোকদ্দমার ফ্যাক্টগুলো শুনেন, দেখবেন সব জায়গায় শুধু পুরুষরাই অপরাধী আর ছেলের মা-বাবা সবচেয়ে খারাপ।
একটা বিষয় আমি আরও স্পষ্ট করে বলতে চাই, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই প্রবাসীদের এই আসামীর কাঠগড়ায় দেখতে পাওয়া যায়। আমি ঠিক বুঝি না, প্রবাসীরা দুই তিন বছরে একবার দেশে আসে তিন মাসের জন্য, এই সময়ের মধ্যে একটা লোক কোথায় তার স্ত্রীর সাথে ভালো রোমান্টিক সময় কাটাবে, না সেখানে সে নাকি তার স্ত্রীর উপর নির্যাতন করে, যৌতুকের জন্য মারধর করে। আজব লাগে না এসব?
আবার শ্বশুর শাশুড়ি বা ছেলের পরিবারের লোকজনের বিরুদ্ধেও এমন সব অভিযোগ আনা হয় যা এতোটাই অবিশ্বাস্য যে, আমার শুধু বলতে ইচ্ছে করে যে, এই শ্বশুর শাশুড়ি বা ছেলের পরিবারের লোকজন এতদিন নির্যাতন করলো না, যেই মাত্র ছেলেটা দেশে আসলো তখনি গিয়ে সবাই মিলে লক্ষ্মী বউটার উপর সবাই মিলে ছড়াও হয়ে গেলো?? একজন প্রবাসী প্রথম বিদেশ যাওয়ার আগে যৌতুক চাইলে সেটা না হয় বিশ্বাসযোগ্য, কিন্তু প্রায় সকল প্রবাসীই বিদেশ থেকে এসে স্ত্রীর কাছে যৌতুক চায়, এটা কেমন জানি হাস্যকর না?
আইনের ছাত্র হিসেবে আইন সম্পৃক্ত সকল সিনেমা মোটামুটি আমার দেখা। কিছুদিন আগে অক্ষয় কুমারের রুস্তম সিনেমাটা দেখেছেন? সেই সিনেমাতে একজন নেভি অফিসারের স্ত্রীর সাথে একজন লোকের পরকীয়ার সম্পর্ক এবং একটি খুন, যা পরে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সেই মামলায় একজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছিল ঠিক এমন যে, আমাদের দেশের সৈনিকরা দেশের স্বার্থে নিজের স্ত্রীকে ঘরে রেখে সীমান্তে বা দেশের বাহিরে যায়, আর কিছু লোক সেই সুযোগে সৈনিকের স্ত্রীর সাথে পরকীয়া করে, সৈনিকের হাতে এইসব পরকীয়া প্রেমিকের খুন হওয়াটাই ঠিক।
আমাদের দেশের প্রবাসীরাও কেবল নিজের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য দেশের বাহিরে যায় না, নিজের উন্নতির পাশাপাশি তার পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে দেশকেও তারা করছে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত। তাদের রেমিটেন্সের টাকায় দেশের বহু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার বেতন ভাতা হচ্ছে। তাহলে কেন তাদের প্রতি এই নির্যাতনটা নিয়ে আমরা একেবারে নিশ্চুপ?
খুন বা আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ব্যাপারে আমরা কোনভাবেই উৎসাহ প্রদান করি না। কিন্তু, এটা হলফ করে বলতে পারি সিংগভাগ প্রবাসীর সংসার ভেঙ্গে দিচ্ছে এই পরকীয়া। বিয়ের আগের প্রেমিক বা বিয়ের পর স্বামীর অনুপস্থিতিতে নতুন করে কারো সাথে প্রেমে জড়িয়ে পড়া, আর মেয়েদের পরিবার থেকে এইসব অপসংস্কৃতিকে তিরস্কারের পরিবর্তে মৌন সম্মতিই প্রবাসীদের সংসার ধ্বংসের মূল কারণ।
প্রায় সব জেলার লোকই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে, সকল প্রবাসীদের উচিত একযোগে সারা দেশ তথা সারাবিশ্ব থেকে সরকারকে একটা ম্যাসেজ দেওয়া এই বিষয়টা নিয়ে। নারীর ক্ষমতায়নে পুরুষের কোন সমস্যা নেই, এটা বরং দেশের জন্য ভালো। কিন্তু, দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সমাজের এই একটি শ্রেণীকে (প্রবাসীকে) আমাদের অবহেলা করলে চলবে না। আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা এই শ্রেণীটিকে, আমাদের আরও বেশী সম্মান করতে হবে এবং বিচারের নামে এদের উপর অবিচার করা বন্ধ করতে হবে। না হলে আরেকটি মিটু আন্দোলন হয়ত প্রবাসীদেরকেই শুরু করতে হবে।
আজ এই পর্যন্তই। আশা করি নিয়মিত লিখবো এই একটি বিষয় নিয়ে, যতদিন না এই অবিচার বন্ধ না হবে। পরবর্তী পর্ব থেকে আমি প্রবাসীদের নির্যাতন এবং অবহেলার বিভিন্ন সত্য ঘটনা নিয়ে লিখবো, সাথে সামাজিক এবং আইনি প্রতিকারও আলোচনার চেষ্টা করবো। আল্লাহ্ হাফেজ।